যৌতুক একটি সামাজিক ক্যান্সার
ভূমিকা: যৌতুক একটি সামাজিক ক্যান্সার। এর বিষক্রিয়ায় আমাদের গোটা সমাজ আক্রান্ত। বর্তমানে যৌতুক প্রথার ভয়াবহতা বাড়লেও এর প্রচলন প্রাচীনকাল থেকেই। নারীজীবনে এ প্রথা অভিশাপস্বরূপ। প্রতিনিয়ত অসংখ্য নারী অত্যাচারিত ও নিপীড়িত হচ্ছে যৌতুকের কারণে। অসংখ্য নারীর সুখের সংসার ভেঙে যাচ্ছে যৌতুকের অভিশাপে। যৌতুকের করাল গ্রাসে নারীর সামাজিক ও মানবিক মর্যাদা লাঞ্ছিত হচ্ছে। যৌতুক প্রথা কেবল নারীকে মর্যাদাহীনই করে না বরং নারী জাতিকে সম্মান হানীর চুড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গেছে।
যৌতুকের সংজ্ঞা: যৌতুকের ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে '''Dowry'''। বিয়ের সময়, আগে, পরে কন্যাপক্ষ বরপক্ষকে যে সকল অর্থ, সম্পদ, অলংকার, আসবাবপত্র, বিনোদনমূলক সামগ্রী দিয়ে থাকে তাকেই যৌতুক বলা হয়। বর্তমানে ধনী পরিবারগুলোতে বিয়ের উপটোকন হিসেবে বাড়ি-গাড়ি ও জায়গা জমিও আদান-প্রদান হয়ে থাকে। সেই উপঢৌপনের ছোবলে ক্ষত বিক্ষত হচ্ছে দরিদ্র ও মধ্যবিত্তরাও।
যৌতুক প্রথার উৎপত্তি ও ইতিহাস: যৌতুক প্রথার উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু জানা যায় না। তবে প্রাচীনকাল থেকেই সমাজে এ প্রথা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে বিস্তার লাভ করেছে। প্রাচীন যুগের রামায়ন ও মহাভারতের বিভিন্ন পৌরাণিক চরিত্রের বিয়েতে যৌতুক আদান-প্রদানের ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। রাজা বল্লাল সেনের সময় প্রচলিত কৌলীণ্য প্রথার ফলে কন্যার পিতাকে বিপুল পরিমাণ অর্থ দানের চুক্তিতে কন্যা অরক্ষণীয়া হওয়ার আগেই কুলীন পাত্রে পাত্রস্থ করতে হত। এছাড়া একটু নিচু বংশের মেয়েকে উঁচু বংশে বিয়ে দিতে হলে মেয়ের বাবাকে পাত্র পক্ষকে প্রচুর অর্থ সম্পদ দেয়াটা ছিল তখনকার দিনের নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা। এছাড়াও মধ্যযুগে মঙ্গলকাব্যসহ অন্যান্য কাব্যে যৌতুক প্রথার ব্যাপক প্রচলন সম্পর্কে জানা যায়। আমাদের ভারত উপমাহাদেশে মুলত সনাতন ধর্মের প্রভাব থেকে ও তাদের কৃষ্টি কালচার মুসলিম সমাজে প্রবেশ করে, সেই সাথে যৌতুক নামক ক্যান্সার টিও সমাজে স্থান করে নিয়েছে। যেনে রাখা ভাল যে ইসলাম ধর্মে যৌতুক আদান প্রদান একটি গর্হিত কাজ, যা সম্পর্ন ভাবে নিসিদ্ধ এবং শাস্তি যোগ্য অপরাধ।
যৌতুক প্রথার কারণ: যৌতুক প্রথার প্রধান কারণ হচ্ছে অর্থলোভ। অনেক সময় অর্থের লালসায় ছেলের পরিবার ছেলেকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে থাকে। এছাড়াও আমাদের দেশে দারিদ্র্য বা আর্থিক দূরবস্থাও যৌতুক প্রথা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। দরিদ্রতার চাপে বা অভাবে পরে অনেকে যৌতুক নিয়ে থাকে। পুরুষ শাসিত সমাজে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস নারীদের উপযুক্ত মর্যাদাদানে বাধা দেয় যা যৌতুক প্রথাকে উদ্বুদ্ধ করে। এছাড়াও অধিকারহীনতা ও অশিক্ষা, সামাজিক প্রতিপত্তি ও প্রতিষ্ঠা লাভের মোহ, উচ্চবিলাসী জীবনযাপনের বাসনা ইত্যাদি যৌতুক প্রথার অন্যতম কারণ।
যৌতুকের বিরূপ প্রভাব: যৌতুক প্রথা আমাদের সমাজ জীবনে ব্যাপক সমস্যার সৃষ্টি করেছে। যৌতুকের লোভে পছন্দ অনুযায়ী বিয়ে না হওয়ায় অনেক সময়ই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মিলবন্ধন তৈরি হয় না। যৌতুকের অর্থের পরিমাণ সামান্য কম হলেই দরিদ্র পরিবারের মেয়ের উপর নানারকম অসহনীয় অত্যাচার ও নির্যাতন করে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা। প্রতিনিয়ত স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির আবদার মেটাতে গিয়ে অনেক দরিদ্র মেয়ের বাবাই নিঃস্ব ও অসহায় হয়েছে। যৌতুকের চাহিদা মেটাতে না পেরে অনেক নারীকেই স্বামীগৃহ ত্যাগ করে পিতৃগৃহে ফিরে আসতে হয়। কখনো কখনো তালাকও প্রদান করা হয়। এভাবে প্রতিনিয়ত অত্যাচার ও নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে অনেক নারীই আত্মহননের পথ বেছে নেয়। এ প্রথা নারী পুরুষের ভেদাভেদ ঘটিয়েছে, নারীকে সামাজিকভাবে হেয় ও পণ্যে পরিণত করেছে। শুধুমাত্র নারী ও পুরুষের মধ্যে অসমতাই সৃষ্টি করে না বরং সামাজিক কাঠামো ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে। এটি অত্যন্ত জঘন্য ও আমানবিক সামাজিক রীতি ও প্রথা যা নারীর মৌলিক অধিকারকে ক্ষুণ্ন করে। অনেক দরিদ্র পিতা-মাতাই যৌতুকের অভিশাপে কন্যা সন্তানকে সানন্দে গ্রহণ করে না। যৌতুকের বিরূপ প্রভাব নারী জীবনের জন্য অবমাননাকর ও আত্মমর্যাদাহানিকর। সম্মানী পুরুষদের জন্যও লজ্জাসকর ব্যাপার।
নারী নির্যাতনে যৌতুক প্রথা: বর্তমানে যৌতুক প্রথার ফলে নিষ্ঠুরতা, নৃশংসতা ও নারী নির্যাতন স্বাভাবিক ব্যাপার। জন অস্টিন যৌতুক প্রথার দ্বারা নারী নির্যাতন সম্পর্কে বলেছেন, ''Dowry system paves the way to women oppression'' যৌতুকের অর্থ না দিতে পারলে সদ্য বিবাহিত নারীকে পদে পদে হেয়, নিচু ও বিদ্রুপ করা হয়। এছাড়া শারীরিকভাবে অমানবিক নির্যাতনের দ্বারা হত্যা করে আত্মহত্যা বলে দাবি করে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকেরা। এছাড়াও শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, এসিড দগ্ধ করা কখনো পুড়িয়ে বা বিষ খাইয়ে মেরে ফেলা, শ্বাসরোধ করে বা গলায় দড়ি আটকিয়ে মেরে ফেলা প্রভৃতি নৃশংসতা হয়ে থাকে যৌতুকের কারণে।
সম্প্রতি যৌতুকের বলি ও নারী নির্যাতনের চিত্র: আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের সাম্প্রতিক রিপোর্টে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর ২০১৩) দেখা যায়, ২০১৩ সালে মোট ২৬৫ জন নারী যৌতুকের বলি হয়েছে। এর মধ্যে ১০৯ জন শারীরিক নির্যাতনের শিকার, ৩ জন এসিডদগ্ধ, ৪ জন স্বামীর গৃহ থেকে বিতাড়িত, ১২৮ জন হত্যার শিকার ও ২১ জন আত্মহত্যা করেছে। ২০১২ সালের একটি রিপোর্টে দেখা যায়, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে যথাক্রমে মোট ৩৭ জন ও ২৪ জন যৌতুকের শিকার। ২০১২ সালের অক্টোবরে ৩৭ জনের মধ্যে ১৮ জন নির্যাতনের শিকার, ১৮ জন হত্যার শিকার ও ১ জন আত্মহত্যা করেছে। এছাড়া BSHER-এর রিপোর্টে দেখা যায়, ২০০৯-১০ বছরে, যৌতুকের ফলে ৩৫৮ জন মৃত ও ১৬৯ জন নির্যাতিত হয়েছে। এছাড়া আরেকটি রিপোর্ট A wife's darkest hour : Dowry violence in bangladesh- এ বলা হয়, ২০০৮ সালে ১৮৬ জন এবং ২০০৭ সালে ১৭২ জন যৌতুকের শিকার হয়েছে। অপর একটি রিপোর্ট' 'Dowry'- A social evil'-এ বলা হয়েছে ২০০৪ সালে ৩৬৭ জন মহিলা যৌতুকের শিকার হয়েছে।
যৌতুক প্রথারোধে গৃহীত পদক্ষেপ: সমাজ থেকে যৌতুক প্রথার মূল উৎপাটনের জন্য দলমত নির্বিশেষে সকল শ্রেণি, পেশা ও ধর্মের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। মানুষের মাঝে ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগ্রত করে সকলের সুস্থ্য মানসিকতা, বলিষ্ঠ জীবনবোধ এবং সমাজকল্যাণমূলক, গঠনশীল দৃষ্টিভঙ্গিই পারে যৌতুক প্রথা নিমূল করতে। যৌতুক প্রথারোধে বর্তমান তরুণ সমাজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। তরুণরাই পারে স্বশিক্ষিত ও বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন হয়ে যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে। এছাড়া নারীসমাজের প্রতি পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন অত্যাবশ্যক। নারীকে পণ্যদ্রব্য হিসেবে বিবেচনা না করে নিজেদের অর্ধাঙ্গী হিসেবে সঠিক মর্যাদা দিতে হবে সমাজের প্রত্যেক পুরুষকে। পুরুষদের অর্থলোভ ত্যাগ করে নারীর গুণ ও গৌরবের তাৎপর্য উপলব্ধি করে সমাজে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যৌতুক দেয়া ও নেয়াকে ঘৃণ্য অপরাধ হিসেবে সকলকে বিবেচনা করতে হবে।
যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে আইন ও যথাযথ প্রয়োগ: বাংলাদেশে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকার বিভিন্ন আইন পাশ করেছে। নারীদের উন্নয়নের জন্য সরকার নারী উন্নয়ন ম্যাগনাকার্টা নামে পরিচিত ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি’ ঘোষণা করেছে। নারী নির্যাতন বন্ধে বিভিন্ন আইন প্রণীত হয়েছে। যেমনঃ (১) যৌতুক বিরোধী আইন ১৯৮০, (২) নারী নির্যাতন প্রতিরোধ আইন ১৯৮৩ (৩) বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ১৯৮৪, (৪) মুসলিম পারিবারিক আইন ১৯৬১ [সংশোধিত ১৯৮৫] (৫) পারিবারিক আদালত আইন ১৯৮৫, (৬) সন্ত্রাস বিরোধী আইন ১৯৯২, (৭) নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ২০০০। নারী নির্যাতন বিরোধী আইনে যৌতুকের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান নিশ্চিত করা হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ২০০০-এ বলা হয়েছে যৌতুকের কারণে কোনো নারীর মৃত্যু হলে এর শাস্তি হবে মৃত্যুদন্ড। মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা করা হলে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হবে। যৌতুকের কারণে আহত করা হলে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হবে। আহত করার চেষ্টা করা হলে অনধিক ১৪ বছরের এবং সর্বনিম্ন ৫ বছরের সশ্রম কারাদন্ড প্রদান করা হবে এবং সকল ক্ষেত্রে আর্থিক দন্ডের বিধান করা হয়েছে। সমস্যা হলো আইন থাকলেও জনসাধারনের সচেতনতার অভাবে তার সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না, তাই আমাদের সবার উচিৎ বেশি করে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা।
উপসংহার: নারী জাতির উন্নয়নের জন্য যৌতুক নামক বিষবৃক্ষের শিকড় নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রয়াসে সমাজ থেকে উপড়ে ফেলতে হবে। সমাজের সকলকে উপলব্ধি করতে হবে নারীরা আমাদেরই মা, বোন ও সন্তান। তাহলেই সমাজ, পরিবার ও রাষ্ট্রে নারীদের সঠিক মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো সম্ভব।
১৩০৬
০
০
কোন তথ্যসূত্র নেই
যৌবনে অাল্লাহর ইবাদত করুন হযরত রাসূল (সাঃ) বলেন- যে যুবক-যুবতী......
ক্যানসারের পাঁচ কারণ বিশ্ব ক্যানসার দিবস । ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর......
পবিত্র শবে বরাতের অামল ও ইবাদত অধ্যক্ষ এম সোলাইমান কাসেমী......
সূখী দাম্পত্যের জন্য প্রয়োজনীয় টিপস ১) একে অপরকে জানিয়ে দিন......
রোহিঙ্গাদের কারণে কক্সবাজারে খদ্য সংকটে বন্যপ্রাণী কক্সবাজারে অবস্থানরত মায়ানমারের প্রায়......
রোজার গুরুত্ব ও মর্যাদা এম সোলাইমান কাসেমী ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের......
“ নাইজেরিয়া ডেল্টা প্রদেশে “ এক সাথে ১০৪ জন খ্রীষ্টান......
অাধুনিক বিয়ে স্বামী-স্ত্রী দু'জনই অপরাধী ইদানীং যে বিয়েগুলো হচ্ছে বিশেষ......
শিশুকালীন যৌন হয়রানি রোধে মায়েদের জন্য ১৩টি গুরুত্বপূর্ণ উপদেশঃ ১.......
২৪ জন ডুবুরি পবিত্র জম জম কূপের তলদেশ থেকে নিয়ে......