হযরত খাদীজা বিনতু খুওয়াইলিদ (রা:)
নাম তাঁর খাদীজা। কুনিয়াত ‘উম্মু হিন্দ’ এবং লকব ‘তাহিরা’। পিতা খুওয়াইলিদ, মাতা ফাতিমা বিনতু যায়িদ। জন্ম ‘আমুল ফীল’ বা হস্তীবর্ষের পনের বছর আগে মক্কা নগরীতে। পিতৃ-বংশের উর্ধ পুরুষ কুসাঈ-এর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহর সা. নসবের সাথে তাঁর নসব মিলিত হয়েছে। জাহিলী যুগেই পূতপবিত্র চরিত্রের জন্য ‘তাহিরা’ উপাধি লাভ করেন। (আল-ইসাবা) রাসূলুল্লাহ সা. ও খাদীজার রা. মধ্যে ফুফু-ভাতিজার দূর সম্পর্ক ছিল। এ কারণে, নবুওয়াত লাভের পর খাদীজা রা. রাসূলুল্লাহকে সা. তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবন নাওফিলের কাছে নিয়ে গিয়ে বলেন, ‘আপনার ভাতিজার কথা শুনুন।’ সম্ভবতঃ বংশগত সম্পর্কের ভিত্তিতেই তিনি একথা বলেছিলেন।
পিতা খুওয়াইলিদ তৎকালীন আরব সমাজের বিশিষ্ট তাওরাত ও ইনজীল বিশেষজ্ঞ ওয়ারাকা ইবন নাওফিলকে খাদীজার বর নির্বাচন করেছিলেন, কিন্তু কেন যে তা বাস্তবে রূপ লাভ করেনি সে সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা নীরব। শেষ পর্যন্ত আবু হালা ইবন যারারাহ আত-তামীমীর সাথে তাঁর প্রথম বিয়ে হয়। জাহিলী যুগেই তাঁর মৃত্যু হয়। আবু হালার মৃত্যুর পর ’আতীক বিন আবিদ আল-মাখযুমীর সাথে তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে হয়। (শারহুল মাওয়াহিব, আল-ইসতিয়াব) তবে কাতাদার সূত্রে জানা যায়, তাঁর প্রথম স্বামী ’আতীক, অতঃপর আবু হালা। ইবন ইসহাকও এ মত সমর্থন করেছেন বলে ইউনুস ইবন বুকাইর বর্ণনা করেছেন। (আল ইসাবাঃ ৪/২৮১) তবে প্রথমোক্ত মতটি ইবন আবদিল বার সহ অধিকাংশের মত বলে ইবন হাজার উল্লেখ করেছেন।
খাদীজার পিতা খুওয়াইলিদ ইবন আসাদ ছিলেন ফিজার যুদ্ধে নিজ গোত্রের কমাণ্ডর। তিনি ছিলেন বহু সন্তানের জনক। প্রথম পুত্র হিযাম। এই হিযামের পুত্র প্রখ্যাত সাহাবী হাকীম জাহিলী যুগে মক্কার ‘দারুন নাদওয়ার’ পরিচালনভার লাভ করেছিলেন। দ্বিতীয় সন্তান হযরত খাদীজা। তৃতীয় সন্তান ‘আওয়াম’ প্রখ্যাত সাহাবী হযরত যুবাইরের রা. পিতা। রাসূলুল্লাহর সা. ফুফু এবং হযরত হামযার আপন বোন হযরত সাফিয়্যা রা. ছিলেন ‘আওয়ামের’ স্ত্রী বা যুবাইরের রা. মা। সাফিয়্যা ছিলেন খাদীজার ছোট ভাইয়ের বউ। চতুর্থ সন্তান হালা। তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর সা. মেয়ে হযরত যয়নাবের রা. স্বামী আবুল আস ইবন রাবী’র মা। আবূল আ’স রাসূলুল্লাহর সা. বড় জামাই। পঞ্চম সন্তান রুকাইয়া। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে হিযাম, আওয়াম এবং রুকাইয়া ইসলামের আবির্ভাবের আগেই মারা যান। হযরত খাদীজা ও হালা ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন।
খাদীজার পিতার মৃত্যু কখন হয়েছিল, সে সম্পর্কে মতভেদ আছে। কেউ বলেছেন, ‘ফিজার’ যুদ্ধে মারা যান। ইমাম সুহাইলীর মতে ফিজার যুদ্ধের আগেই মারা যান। তখন খাদীজার বয়স পঁয়ত্রিশ। কারো কারো মতে রাসূলুল্লাহর সা. বিয়ের পর তিনি মারা যান। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৬৫২)।
পিতা বা স্বামীর মৃত্যু বা যে কোন কারণেই হোক কুরাইশ বংশের অনেকের মত খাদীজাও ছিলেন একজন বড় ব্যবসায়ী। ইবন সা’দ তাঁর ব্যবসায় সম্পর্কে বলছেনঃ ‘খাদীজা ছিলেন অত্যন্ত সম্মানিত ও সম্পদশালী ব্যবসায়ী মহিলা। তাঁর বাণিজ্য সম্ভার সিরিয়া যেত এবং তাঁর একার পণ্য কুরাইশদের সকলের পণ্যের সমান হতো।’ ইবন সা’দের এ মন্তব্য দ্বারা খাদীজার ব্যবসায়ের পরিধি উপলব্ধি করা যায়। অংশীদারী বা মজুরী বিনিময়ে যোগ্য লোক নিয়োগ করে তিনি দেশ বিদেশে মাল কেনাবেচা করতেন।
রাসূলুল্লাহ সা. তখন পঁচিশ বছরের যুবক। এর মধ্যে চাচা আবু তালিবের সাথে বা একাকী কয়েকটি বাণিজ্য সফরে গিয়ে ব্যবসায় সম্পর্কে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেলেছেন। ব্যবসায়ে তাঁর সততা ও আমানতদারীর কথাও মক্কার মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। সবার কাছে তিনি তখন আল-আমীন। তাঁর সুনামের কথা খাদীজার কানেও পৌঁছেছে। বিশেষতঃ তাঁর ছোট ভাই-বউ সাফিয়্যার কাছে আল-আমীন মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে বহু কথাই শুনে থাকবেন।
হযরত খাদীজা একবার কেনাবেচার জন্য সিরিয়ায় পণ্য পাঠাবার চিন্তা করলেন। যোগ্য লোকের সন্ধান করছেন। এ প্রসঙ্গে ওয়াকিদী থেকে যারকানীর বর্ণনাঃ ‘আবু তালিব মুহাম্মাদকে সা. ডেকে বললেনঃ ভাতিজা! আমি একজন দরিদ্র মানুষ, সময়টাও খুব সঙ্কটজনক। মারাত্মক দুর্ভিক্ষের কবলে আমরা নিপতিত। আমাদের কোন ব্যবসায় বা অন্য কোন উপায়-উপকরণ নেই। তোমার গোত্রের একটি বাণিজ্য কাফিলা সিরিয়া যাচ্ছে। খাদীজা তাঁর পণ্যের সাথে পাঠানোর জন্য কিছু লোকের খোঁজ করছে। তুমি যদি তার কাছে যেতে, হয়তো তোমাকেই সে নির্বাচন করতো। তোমার চারিত্রিক নিষ্কলুষতা তার জানা আছে। যদিও তোমার সিরিয়া যাওয়া আমি পছন্দ করিনে এবং ইয়াহুদীদের পক্ষ থেকে তোমার জীবনের আশঙ্কা করি, তবুও এমনটি না করে উপায় নেই।’ জবাবে রাসূল সা. বললেন, সম্ভবতঃ সে নিজেই লোক পাঠাবে। আবু তালিব বললেনঃ হয়তো অন্য কাউকে সে নিয়োগ করে ফেলবে। চাচা-ভাতিজার এ সংলাপের কথা খাদীজার কানে গেল। ‘তিনি রাসূলুল্লাহর সা. নিকট লোক পাঠালেন।’ (টীকা, সীরাতু ইবন হিশাম- ১/১৮৮) উল্লেখ থাকে যে, কৈশোরে একবার রাসূল সা. চাচার সাথে সিরিয়া গিয়েছিলেন। তখন পাদরী ‘বুহাইরা’ রাসূলুল্লাহ সা. সম্পর্কে আবু তালিবকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন্। উপরোক্ত বর্ণনায় আবু তালিব সে দিকেই ইঙ্গিত করেছেন।
খাদীজা লোক মারফত মুহাম্মাদের সা. কাছে প্রস্তাব পাঠালেন, তিনি যদি ব্যবসায়ের দায়িত্ব নিয়ে সিরিয়া যান, অন্যদের তুলনায় খাদীজা তাঁকে দ্বিগুণ মুনাফা দেবেন। মুহাম্মাদ সা. রাজী হলেন।
খাদীজার রা. পণ্য-সামগ্রী নিয়ে তাঁর বিশ্বস্ত দাস মায়সারাকে সঙ্গে করে মুহাম্মাদ সা. চললেন সিরিয়া। পথে এক গীর্জার পাশে একটি গাছের ছায়ায় বসে আছেন তিনি। গীর্জার পাদ্রী এগিয়ে গেলেন মায়সারার দিকে। জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘গাছের নিচে বিশ্রামরত লোকাটি কে?’ মায়সারা বললেনঃ ‘মক্কার হারামবাসী কুরাইশ গোত্রের একটি লোক।’ পাদ্রী বললেনঃ ‘এখন এই গাছের নীচে যিনি বিশ্রাম নিচ্ছেন তিনি একজন নবী ছাড়া আর কেউ নন।’ ঐতিহাসিকরা এই পাদ্রীর নাম ‘নাসতুরা’ বলে উল্লেখ করেছেন। (টীকা, সীরাতু ইবন হিশাম- ১/১৮৮) তবে ইবন হাজার ’আসকালানী এই পাদ্রীর নাম ‘বুহাইরা’ বলেছেন। (আল-ইসাবাঃ ৪/২৮১) তিনি আরো বলেছেন, এই বাণিজ্য সম্ভার নিয়ে রাসূল সা. বসরার বাজারে গিয়েছিলেন। তাবারী ইবন শিহাব যুহরী থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সা. খাদীজার পণ্য নিয়ে সিরিয়া নয়, বরং ইয়ামনের এক হাবশী বাজারে গিয়েছিলেন। তবে সিরিয়া যাওয়ার বর্ণনাটাই সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। (তারীখুল উম্মাহ আল ইসলামিয়া, মুহাম্মদ আল-খিদরী বেকঃ ১/৬৪)
রাসূলুল্লাহ সা. সিরিয়ার বাজারে পণ্যদ্রব্য বিক্রী করলেন এবং যা কেনার তা কিনলেন। তারপর মায়সারাকে সঙ্গে করে মক্কার পথে রওয়ানা হলেন। পথে মায়সারা লক্ষ্য করলেন, রাসূল সা. তাঁর উটের ওপর সওয়ার হয়ে চলেছেন, আর দু’জন ফিরিশতা দুপুরের প্রচণ্ড রোদে তাঁর ওপর ছায়া বিস্তার করে রেখেছে। এভাবে মক্কায় ফিরে খাদীজার পণ্য-সামগ্রী বিক্রী করলেন। ব্যবসায়ে এবার দ্বিগুণ অথবা দ্বিগুণের কাছাকাছি মুনাফা হলো। বাড়ী ফিরে বিশ্বস্ত ভৃত্য মায়সারা তাঁর মনিব খাদীজার নিকট পাদ্রীর মন্তব্য এবং সফরের অলৌকিক ঘটনাবলী সবিস্তার বর্ণনা করলেন। (সীরাতু ইবন হিশাম- ১/১৮৯)
হযরত খাদীজা রা. ছিলেন এক বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমতি ভদ্র মহিলা। তাঁর ধন-সম্পদ, ভদ্রতা ও লৌকিকতায় মক্কার সর্বস্তরের মানুষ মুগ্ধ ছিল। অনেক অভিজাত কুরাইশ যুবকই তাঁকে সহধর্মিনী হিসেবে লাভ করার প্রত্যাশী ছিল। তিনি তাদের সকলকে প্রত্যাখ্যান করেন। মায়সারার মুখে সবকিছু শুনে খাদীজা নিজেই রাসূলুল্লাহর সা. নিকট বিয়ের পয়গাম পাঠান। (সীরাতু ইবন হিশাম- ১/১৮৯)
বিয়ের প্রস্তাব কিভাবে এবং কেমন করে হয়েছিল সে সম্পর্কে নানা রকম বর্ণনা রয়েছে। তবে খাদীজাই যে সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহর সা. নিকট প্রস্তাবটি পেশ করেন সে ব্যাপারে সব বর্ণনা একমত।
একটি বর্ণনায় এসেছে, খাদীজা রা. নিজেই রাসূলুল্লাহর সা. সাথে কথা বলেন এবং তাঁর পিতার নিকট প্রস্তাবটি উত্থাপন করার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনি অস্বীকৃতি জানান এই বলে যে, দারিদ্রের কারণে হয়তো খাদীজার পিতা তাঁকে প্রত্যাখ্যান করবেন। অবশেষে খাদীজার পিতা যখন অতিরিক্ত মদপান করে মাতাল অবস্থায় ছিলেন তখন খাদীজা নিজেই বিষয়টি তাঁর কাছে উত্থাপন করেন এবং সম্মতি আদায় করেন। কিন্তু সুস্থ হয়ে আবার তিনি বেঁকে বসেন। তবে খাদীজা পুনরায় তাঁর সম্মতি আদায় করেন। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৬৫২) অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, হযরত ইয়ালার স্ত্রী ও খাদীজার বান্ধবী ‘নাফীসা বিনতু মানিয়্যা’ এ ব্যাপারে পুরো উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনিই সর্বপ্রথম খাদীজার পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট এভাবে প্রস্তাব পেশ করেনঃ ‘আপনাকে যদি ধন-সম্পদ, সৌন্দর্য ও জীবিকার নিশ্চয়তার দিকে আহ্বান জানানো হয়, আপনি কি গ্রহণ করবেন? ….এ কথাগুলি ছিল হযরত খাদীজা সম্পর্কে।
কথা পাকাপাকি হয়ে গেল। নির্ধারিত তারিখে আবু তালিব, হামযাসহ রাসূলুল্লাহর সা. খান্দানের আরো কিছু ব্যক্তি খাদীজার বাড়ী উপস্থিত হলেন। খাদীজাও তাঁর খান্দানের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে দাওয়াত দিয়েছিলেন। সকলের উপস্থিতিতে আবু তালিব বিয়ের খুতবা পাঠ করলেন। সাহিত্যিক উৎকর্ষের দিক দিয়ে এ খুতবা জাহিলী যুগের আরবী-গদ্য সাহিত্যে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। পাঁচশ’ স্বর্ণমুদ্রা মোহর ধার্য হয়। খাদীজা নিজেই উভয় পক্ষের যাবতীয় খরচ বহন করেছিলেন। তিনি দুই উকিয়া সোনা ও রুপো রাসূলুল্লাহর সা. নিকট পাঠান এবং তা দিয়ে উভয়ের পোশাক ও ওয়ালীমার বন্দোবস্ত করতে বলেন। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৬৫২) এভাবে হযরত খাদীজা হলেন ‘উম্মুল মুমিনীন’। এটা নবুয়াত প্রকাশের পনের বছর পূর্বের ঘটনা। সে সময় তাঁদের উভয়ের বয়স সম্পর্কে সীরাত বিশেষজ্ঞদের মতপার্থক্য থাকলেও সর্বাধিক সঠিক মতানুযায়ী রাসূলুল্লাহর সা. বয়স ছিল পঁচিশ এবং খাদীজার চল্লিশ।
গ্রন্থ: অাসহাবে রাসূল (সাঃ) এর জীবনকথা
৪৯৩
০
০
কোন তথ্যসূত্র নেই
রসুনের উপকারিতা শুধু খাবারের স্বাদ বাড়াতেই নয়, ঔষধি গুণের জন্য......
অাল্লাহর সঙ্গে বান্দার অবস্হান আল্লাহর সঙ্গে বান্দার দুইটি অবস্থান খুবই......
রাসূলুল্লাহ(সাঃ) চারিত্রিক গুণাবলী ১. কেউ কথা বলতে বসলে সে ব্যক্তি......
انّما الاعمال بالنّیّات. অর্থ: সমস্ত কাজই নিয়্যতের উপর নির্ভর করে।......
অাল্লাহর উপর ভরসা রাখুন •﴿ وَهُوَ يَتَوَلَّى الصّالِحينَ﴾ (নেককার লোকদের......
অাপনি সৎকর্মশীল হোন আপনি যদি আপনার সন্তানদের সুন্দর ও সুখী......
অাল্লাহ সহনশীল নিশ্চয়ই আল্লাহ আসমান ও যমীনকে স্থির রাখেন, যাতে......
আবূল ইয়ামান (রহঃ) ... আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে,......
শয়তানের অনুসরণ করো না আল্লাহ তা'আলা বলেন- হে ঈমানদারগণ, তোমরা......
হজ্বের সফর : কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হজ্বের সফর আর অন্য......